এনএফটি কী? কীভাবে বানাবেন? [উদাহরণসহ]

আগের সংখ্যায় ডিসেন্ট্রাল্যান্ডে জমি জমা বেচা বিক্রির যে কথা বললাম, সেটা সম্ভব হয়েছে “এন এফ টি” এর কারণে।

একে বলা যাক ডিজিটালি বেচা বিক্রির রেকর্ড রাখার এক আধুনিক প্রক্রিয়া।

এন এফ টি আপনি কিনলে, আপনি যে কিনেছেন তার রেকর্ড রয়ে যাবে। যেমন আমি এই নিউজলেটার সংখ্যার এন এফ টি বানাতে পারি। সেই এন এফ টি আপনি কিনতে পারেন। অর্থাৎ, ডিজিটাল সার্টিফিকেট বা রেকর্ড থাকবে যে, আপনি এটি কিনেছেন।

কি কি এনএফটি টোকেনে পরিণত করে একজন বিক্রি করতে পারবেন?

চিত্রকর্ম

গান

যেকোন ভার্চুয়াল আইটেম যেমন ভিডিও গেইমের আভাটার, জমি, চরিত্র ইত্যাদি

মানুষ পুরাণ জিনিশ যে সংগ্রহ করে, মানে যেগুলা সংগ্রহযোগ্য, ভ্যালুয়েবল, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ও অকৃত্রিম কবিতা লেখার খাতা

দুষ্প্রাপ্য ভিডিও ফুটেজ

আসলে যেকোন কিছু। এমনকি বাস্তবের জায়গা জমিও এনএফটি করতে পারেন।

আগের সংখ্যায় বলা ডিসেন্ট্রাল্যান্ড ভার্চুয়াল রিয়ালিটি গেইম ভার্চুয়াল জায়গা জমিই বিক্রি করছে, কিন্তু ওভিআর নামে আরেকটি ব্লকচেইন অগমেন্টেড রিয়ালিটি গেইম বাস্তবের জিনিসপত্রই বিক্রি করছে ভার্চুয়ালি।

সম্প্রতি আইফেল টাওয়ার বিক্রি হয়েছে প্রায় ১০৬ হাজার ইউ এস ডলারে। মূল্য ইথেরিয়ামে পরিশোধ করা।

এই গেইম বাস্তবের দুনিয়াকে ১.৬ ট্রিলিয়ন হেক্সাগনে তথা ষড়ভুজে ভাগ করেছে, ও বিক্রি করছে।

ইউজাররা সেখানে জায়গা কিনতে পারেন। তাদের জায়গা ইচ্ছামত ডেভলাপ করতে পারেন। নিজের জায়গায় ওয়েবসাইট বানাতে পারেন।

এখন, আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যিনি আইফেল টাওয়ার এন এফ টি কিনলেন, উনি কি বাস্তবের আইফেল টাওয়ারের মালিক হয়ে গেলেন?

অবশ্যই না।

যিনি ওভিআর গেইমে আইফেল টাওয়ার কিনেছেন, তিনি ওই গেইমের আইফেল টাওয়ারের মালিক হয়ে গেছেন। এই গেইম যারা ইউজ করবে, তারা তার আইফেল টাওয়ার দেখবে। যেহেতু এটি বাস্তব দুনিয়ার একটি বিখ্যাত জায়গা তাই এখানে মানুষের আগ্রহ থাকবে। এই টাওয়ারের মালিক সেই আগ্রহ কাজে লাগাতে পারবেন ও সেখান থেকে নানা ভাবে মানি জেনারেট করতে পারবেন, তার সে ইচ্ছা থাকলে।

এই গেইম শুরু হবার চার মাসের মধ্যে প্রায় ২৪০০০০ এনএফটি বিক্রি হয়েছে। প্রায় ৫ হাজার ইউজার এটি প্রতিদিন ভিজিট করছেন।

যত গেইমটি জনপ্রিয় হবে, যত বেশি মানুষ ব্যবহার করবেন, তত এখানে জায়গা জমির দাম বাড়বে।

এন এফ টির একটা ব্যবহার হতে পারে বিখ্যাত আর্টিস্ট, গায়ক বা যাদের ফ্যান ফলোয়ার আছে এমন ব্যক্তিদের অর্থ উপার্জনের জন্য।

এইসব ব্যক্তিদের, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা ক্রিয়েট করেন কোন শিল্প কর্ম বা গান বা লেখা ইত্যাদি। তাদের ফ্যান ফলোয়াররা সেগুলির ভোক্তা। কিন্তু মাঝখানে প্লাটফর্ম বা মাধ্যমে হিসেবে থাকে তৃতীয় পক্ষ, যারা হতে পারে যেকোন মধ্যস্বত্তভোগী, ইভেন ইন্টারনেট ভিত্তিক কন্টেন্ট ডিস্ট্রিবিউশন মাধ্যমগুলিতেও ফেসবুক, ইউটিউব এসব কর্পোরেট কোম্পানি মধ্যস্বত্তভোগী হিসেবে কাজ করে।

আর্টিস্ট ব্যক্তি যদি নিজে সরাসরি তার ফ্যানের কাছে বিক্রি করতে পারেন, সরাসরি টাকা পান, তাহলে সেটা তার জন্য লাভজনক।

এনএফটি হয়ত ডিজিটাল এক সার্টিফিকেট বা মালিকানার রেকর্ড ছাড়া কিছু দিচ্ছে না। কিন্তু কোন গায়ক যদি বলেন, তিনি তার কোন বিখ্যাত গানের একেবারে প্রথম গাওয়া আনপাবলিশড ভার্সন এনএফটি টোকেনে বিক্রি করবেন, নিলামে, তাহলে তার ডাই হার্ড ফ্যানেরা এতে অংশ নিতে পারেন, এবং অনেক বেশি দামে কোন ফ্যান কিনে নিতে পারেন।

এখন পর্যন্ত এটাই এক সল্যুশন, সরাসরি আর্টিস্টের খ্যাতি বিক্রি করার।

এখানে ফ্যানের লাভ কী?

তিনি এমন এক জিনিশ কিনলেন, তার প্রিয় বিখ্যাত ব্যক্তির, যা এক কপিই আছে। ক্রেতা হিসেবে তার নাম হল। যে অমুক এটি এত দামে কিনেছেন। বিশ্বের বিলিয়ন ডলারের আর্ট ইন্ড্রাস্ট্রি তো এর উপরই চলে। এন্ডি ওয়ারহলের যেন তেন আঁকা ছবিই লাখ লাখ ডলার হয়, কারণ এটি ওয়ারহলের তাই। যে কিনেছে আর্ট সংগ্রাহকদের দুনিয়ায় তার নাম হয়। রুচিশীল ধনী হিসেবে পরিচিতি হয়।

তাছাড়া আর্টঅয়ার্কের ইনভেস্টমেন্ট পার্টও আছে। অনেকে এগুলিকে ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে দেখেন। যেহেতু ওয়ারহল, ভ্যানগগ বা এরকম বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলি সীমিত, তাই এই দুষ্প্রাপ্যতার জন্যই এদের দাম দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়।

ফলে, কেউ এগুলি কিনে রাখতে পারেন পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য।

এনএফটির ক্ষেত্রেও একই কথা।

কেউ এন এফ টি কীভাবে বানাতে পারেন?

আগে ঠিক করতে হবে কোন ব্লকচেইন ব্যবহার করবেন। এখন পর্যন্ত এনএফটির জন্য সবচাইতে বিখ্যাত ব্লকচেইন হল ইথেরিয়াম। এছাড়া ট্রন, ইওএস, পলকাডট, তেজস, কসমস ইত্যাদি নানা ব্লকচেইন আছে। এন এফ টির জন্য তাদের প্রত্যেকের আলাদা ওয়ালেট, মার্কেটপ্লেস, টোকেন স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদি রয়েছে।

ধরা যাক, আপনি গায়ক, প্রথম গানের এন এফ টি বানাবেন, পাগলা ফ্যানদের জন্য, এর সহজ কথায় স্টেপ বাই স্টেপ গাইড কী হবে।

১। প্রথমে ওয়ালেট খুলে কিছু ইথেরিয়াম কিনবেন (অকশন লিস্ট করতে হলে ফি দিতে লাগবে)। কয়েনবেইজে বা মেটামাস্কে করতে পারবেন। এই লেখার জন্য আমি একটু আগে মেটামাস্কে ওয়ালেট খুললাম।

২। তারপর কোন এনএফটি মার্কেটপ্লেসে গিয়ে এনএফটি বানাতে হবে। যেমন, অপেনসি’তে গেলেন। আপনার ইথেরিয়াম ওয়ালেট কানেক্ট করলেন।

অতঃপর আপনার আর্টওয়ার্ক আপলোড করলেন। ক্রিয়েট এনএফটি ইত্যাদি বাটন ক্লিক করে, ডেসক্রিপশন নাম ধাম ইত্যাদি দিলেন। কীভাবে বিক্রি করবেন, এক দামে বা না নিলামে ইত্যাদি ঠিক করলেন।

এই লেখার জন্য এনএফটি বানানোর প্রক্রিয়া, এটা সত্যজিৎ রায়ের লেখার কালেকশনের ছবি।

যদি সিরিয়াসলি আপনি এন এফটি করতে চান তাহলে এই প্রক্রিয়া অবশ্যই বিস্তারিত দেখে নেবেন। কিন্তু সহজ ভাষায় এটাই প্রক্রিয়া।

৩। খরচ কত পড়বে? ইথেরিয়ামের এনএফটি মিন্ট করতে গ্যাস ফি এর জন্য খরচ লাগে। সেই টাকার পরিমাণ আবার ওই সময়ের কনজেশন কেমন তার উপর নির্ভর করে ১ থেকে ১০০০ ডলারের মধ্যে। কোন কোন প্লাটফর্ম, যেমন অপেনসি বিক্রি হবার আগে মিন্ট করে না, সেই ক্ষেত্রে তারা ফ্রিতে এনএফটি ক্রিয়েট করতে দেয়। বিক্রি হলেই গ্যাস ফি লাগে ইথেরিয়াম ব্লকচেইনে মিন্ট করতে। ফলে বিক্রির সময় ফি এর খরচ কাটে।

ফিক্সড প্রাইসে বায়ার ফি বহন করে। অকশন প্রাইসে সেলার।

অকশন লিস্ট করতে হলে, প্রথমবারের ক্ষেত্রে একটা গ্যাস ফি কাটে। যেমন আমার এনএফটির ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত গ্যাস ফি এসেছে। কিন্তু যেহেতু এটা আমি বিক্রির উদ্দেশ্যে করছি না, এবং নিশ্চিত বিক্রি হবে না তাই অহেতুক ফি দিয়ে লিস্ট করার দরকার নেই।

কিন্তু অকশনে লিস্ট না করলেও আমার এনএফটি কিন্তু তৈরি হয়ে গেছে। বায়ার চাইলে দাম অফার করতে পারবে।

একাউন্টে মিনিমাম থ্রেশল্ড দিয়ে রাখা যায়। অফার এর বেশি হলে ওপেন সি ইমেইল করে জানাবে।

আমি একটা উচ্চ থ্রেশল্ড দিলাম।

আমার এন এফ টির লিংক –

প্রথম এন এফ টি

এন এফ টি বেচাবিক্রির একটা বড় ইন্ড্রাস্ট্রি আবির্ভূত হয়েছে। মিলিয়ন ডলারের এনএফটি বিক্রি হয়েছে, ও হচ্ছে। যেমন একজন ডিজিটাল আর্টিস্ট বিপল, তার এন এফটি সেল করেছিল ৬৯ মিলিয়ন ডলারে। সেটা হয়েছে ক্রিস্টি অকশনে, যেখানে আবার এরকম বেচাবিক্রি নিয়মিতই হয়, নানা ধরণের এবস্ট্রাক্ট চিত্রকর্মের।

কভিডের লকডাউনে ফিল্মমেকার এলেক্স র‍্যামিরেজ মেলিস ও তার চার বন্ধু ওয়াটস আপে নিজেদের পাদ মারার শব্দ আদান প্রদান করতেন। র‍্যামিরেজ পরে সেগুলি নিয়ে ৫২ মিনিটের অডিও বানান ও এনএফটি হিসাবে। দুই মাস আগে এটি বিক্রি হয় ০.২৪ ইথেরিয়াম বা আজকের হিসাবে প্রায় ৬০০ ডলারে।

অর্থাৎ, এনএফটি মহার্ঘ কোন বস্তু নয়। আপনি বানালেই বিক্রি হয়ে যাবে এমন নয়।

এনএফটি বিষয়ে মূল কথা হল, আপনার ফ্যান ফলোয়ার আছে কি না ওই জিনিশ কেনার জন্য যা আপনি বিক্রি করবেন। সেই জিনিশ কী সেটা ম্যাটার করে কম।

এই জায়গাতেই বিখ্যাত লোকেরা তাদের ফেইম সরাসরি অর্থমূল্যে বিক্রি করতে পারেন।

অনেকে চ্যারিটির উদ্দেশ্যেও করতে পারেন। যেমন টুইটারের ফাউন্ডার জ্যাক ডর্সি তার প্রথম টুইটের এনএফটি ২.৯ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেন চ্যারটির জন্য।

ইন্ডিয়ান মিউজিসিয়ান ক্লাবের বাসুকির একটা ডেমো গানের এনএফটি বিক্রি হয়েছে ৫০ ইথেরিয়াম বা ১.৫ কোটি রূপিতে। যেটা আবার কিনেছে বিপলের আর্ট ৬৯ মিলিয়ন ডলারে কেনা ভিগনেশ সুন্দারেসান। আপনি বলতে পারেন একটা জেপিজি ছবির ফাইল আর সেটা কিনার রেকর্ড, এই জিনিশ এত দাম দিয়ে কেনার লাভ কী?

লাভ বা ভ্যালু একেকজন একেকভাবে দেখে। চিন্তা করুন যদি আগামী দশ বা পঞ্চাশ বছর পরের দুনিয়া ব্লকচেইন নির্ভর হয়, এনএফটি সর্বসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়, তখন এই সুন্দারেসান তার প্রথম এত দামে কেনা এনএফটি, যা ডিজিটাল আর্টের নতুন এরার শুরুর হিসেবে বিখ্যাত হয়ে থাকবে, এটি ভার্চুয়াল মিউজিয়ামে প্রদর্শন করেই ৬৯ মিলিয়নের চেয়ে অনেক বেশি বের করতে পারবে। বা একেক টুকরা করে বিক্রি করতে পারে, কারণ ততদিনে এটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *