লাইফে যে “সূত্রটি” বুঝা একান্ত জরুরী

ইনভেস্টিং এর ক্ষেত্রে একজন ইনভেস্টরকে চিন্তা করতে হয় কম্পাউন্ডিং এর মাধ্যমে। ধরা যাক, আপনার কাছে আছে ২৫ হাজার ডলার। আপনি একটা স্টকে ইনভেস্ট করলেন যা আপনাকে বছরে ২০% হারে রিটার্ন দেয়। সেক্ষেত্রে, আপনার মূল টাকা দ্বিগুণ হতে কত সময় লাগবে?

৭২ এর রুল অনুযায়ী, ৭২ কে রিটার্ন হার দিয়ে ভাগ করলে আপনি পাবেন কতদিনে আপনার টাকা দ্বিগুণ হবে। উপরিউক্ত উদাহরণের ক্ষেত্রে, ৭২/ ২০ = ৩.৬ বছর।

৩.৬ বছরে আপনার ২৫ হাজার ডলার ৫০ হাজার ডলার হবে। এটা শুনতে আহামরি কিছু মনে হয় না।

আপনি যদি ২০২১ সাল থেকে ২০৫৬ সাল পর্যন্ত ইনভেস্ট করে রাখেন, আর এই হারে রিটার্ন পেয়ে যান, তখন কী হবে?

২০২১ থেকে ২০৫৬ সাল পর্যন্ত বছর হয় ৩৬ বছর।

ডাবল হতে লাগে ৩.৬ বছর, তাহলে ৩৬ বছরে মোট ডাবল হবে ৩৬/৩.৬ = ১০ টা।

প্রথম ডাবলে ১ ডলার হবে ২ ডলার।

২ ডাবলে ২ ডলার হবে ৪ ডলার।

১০ ডাবলে ১ ডলার হবে ১০২৪ ডলার।

১০০০% গ্রোথ।

আমাদের মূল টাকা ছিল ২০২১ সালে ২৫ হাজার ডলার। ২০৫৬ সালে গিয়ে দাঁড়াবে

২৫০০০ * ১০০০ = ২৫০০০০০০ অর্থাৎ ২৫ মিলিয়ন ডলার। বা ২৫০ লাখ ডলার।

মানুষ সব সময় লিনিয়ার বা এক রৈখিক গ্রোথে চিন্তা করে। কিন্তু কম্পাউন্ডিং এর ক্ষেত্রে গ্রোথ হয় এক্সপোনেনশিয়াল। এইজন্য, একটা সময়ের পরে গ্রোথ অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে চলে।

বহু পুরনো একটি গল্প আছে, দাবা খেলার আবিষ্কারক এবং একজন রাজাকে নিয়ে। দাবা খেলা যিনি আবিষ্কার করলেন, রাজা তাকে পুরস্কার দিতে চাইলেন, জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি চাও?

আবিষ্কারক বললেন, দাবার বোর্ডে প্রতি ঘরে এক শস্যদানা করে দিন, এবং পরের ঘরে এর দ্বিগুণ, তার পরের ঘরে এর দ্বিগুণ, এভাবে মহারাজ।

রাজা ভাবলেন এ আর এমন কী।

কিন্তু, দাবার বোর্ডের মধ্যপথে আসতে আসতে দেখা গেল রাজ্যের সব শস্যদানা উজাড় করে দিয়েও শেষ হচ্ছে না। অবস্থা এমন যে, পুরো রাজ্যই দিতে হবে।

এই কথিত গল্পটি এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ আসলে কত দ্রুত অনেক বেশি বেড়ে যায় তা বুঝাতে, সেই ১২৫৬ সালের আগে থেকে প্রচলিত।

কিন্তু ঐ গল্পের রাজা যেমন এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ বুঝেন নি, তেমনি আধুনিক মানুষেরাও বুঝেন না, যেটা করোনা ভাইরাসের ক্রাইসিসের সময় দেখা গেল ২০২০ সালে। ভাইরাসটি এইভাবে দ্রুত ছড়িয়ে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে অবস্থা মারাত্মক করে তুলেছিল। নীতিনির্ধারকেরা ও রাষ্ট্রনায়কেরা এটা আগে ধরতে পারেন নি।

কম্পাউন্ড এই গ্রোথের ক্ষেত্রে, সময় গুরুত্বপূর্ণ। এই জন্য টেকনোলজি স্ট্র্যাটেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে, দাবা বোর্ডের দ্বিতীয়ার্ধ। বোর্ডের দ্বিতীয় অর্ধেক অংশেই গ্রোথ দানবীয় রূপ ধারণ করে।

আগের উদাহরণে যাই, প্রথম কয়েক বছরে ২০% রিটার্নে খুব অল্প অল্পই বাড়ে। যেমন, প্রথম ৫ বছর পরে গ্রোথ মাত্র ৩২ গুণ। কিন্তু ১০ বছরে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১০০০ গুণে।

কিন্তু এখানে কথা হল, দীর্ঘ সময় ধরে ২০% রিটার্ন আনা সহজ কি না?

অবশ্যই সহজ না। খুবই কঠিন। কিন্তু অসম্ভব না।

ওয়ারেন বাফেটের রিটার্ন ৫২ বছরে প্রায় ১৯-২০% করে।

ব্যারনসের সূত্রে, ওয়ারেন বাফেটের কোম্পানিতে ১০০০ ডলার আপনি ইনভেস্ট করতেন যদি ১৯৬৫ সালে, তাহলে সেই টাকা এখন হতো ২৭ মিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে, এস এন্ড পি ৫০০ ইনডেক্সে ইনভেস্ট করলে আপনার টাকা হতো মাত্র ২০০,০০০ ডলার।

কম্পাউন্ড গ্রোথের সুফলের জন্য রিটার্ন রেইট মেইন্টেইন জরুরী।

কিন্তু সকল বছর গ্রোথ একই ২০% হারে বাস্তবে হয় না। যেমন, বাফেটের বেস্ট বছর ছিল ১৯৭৬ সাল, যেখানে প্রায় ১২৯% রিটার্ন ছিল। আর খারাপ বছর ছিল ১৯৭৪ সাল, সেই বছর ছিল ৪৮% লস।

মার্কেটে উত্থান পতন হয়। যেমন, ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের শেয়ার ৮ ডলার থেকে ৮০ ডলারে চলে গিয়েছিল। তখন ধরা যাক, আমি আপনাকে বললাম এই বাফেট লোকটা অনেক বুদ্ধিমান, এর কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনেক, এই স্টক কিনেন। আপনি কিনলেন ৮০ ডলারে, ১৯৭২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে। ৩ বছর পরে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৫ এ স্টকের দাম ৫৩% কমে গিয়ে হয়েছিল ৩৮ ডলার। আপনি আমাকে গালাগালি করে, বাফেটের কোম্পানিকে গালাগালি করে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু পরের বছরেই স্টকটির দাম ৩৮ থেকে হয়েছিল ৯৪।

১৯৮২ সালে ৭৭৫।

এবং আজ (২৮ ডিসেম্বর, ২০২০) এ ৩৪২৬০১।

ওয়ারেন বাফেট সবচাইতে বিখ্যাত এবং সফল একজন ইনভেস্টর। তার কথা এখানে আনা তারে হিরো বন্দনা করতে না, বরং কম্পাউন্ডিং ইফেক্ট এর ক্ষমতা বুঝাতে। তার সাকসেসে তার স্কিলের সাথে লাক, এবং অন্যান্য ফ্যাক্টর ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই তিনি কম্পাউন্ডিং ইফেক্ট বুঝতে পেরেছিলেন, এবং একে কাজে লাগানোর উপায় বের করেছিলেন। যার সুফল তিনি পেয়েছেন।

এই কম্পাউন্ড ইফেক্ট দুনিয়ার যেকোন মানুষের জন্য কাজ করতে পারে, যদি সে এটা বুঝতে পারে ও কাজে লাগাতে পারে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, “কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট হলো দুনিয়ার অষ্টম আশ্চর্য। যে এটা বুঝে সে অর্জন করে, আর যে বুঝে না সে পরিশোধ করে।”

আপনি হয়ত ভাবছেন কম্পাউন্ডিং এত সহজ, তাহলে সব মানুষ কেন এটি ব্যবহার করে না তাঁদের চিন্তায় ও কাজে?

মানুষের ব্রেইন কিছু লজিক্যাল ক্যালকুলেশন করে, এবং এরপর সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন, সামনে একটা খালের মোট জায়গা পড়েছে, যার উপর দিয়ে পানি যাচ্ছে, এটি পার হয়ে আপনাকে অন্য পাড়ে যেতে হবে। এমতাবস্থায়, ব্রেইন প্রথমত ভিজুয়াল ডেটা নিবে যে তার দেখায় পানির গভীরতা কত। পানির তল দেখা যায় কি না, ইত্যাদি। এর পর এই ডেটার উপর ভিত্তি করে ব্রেইন হিসাব করে দেখবে, এটি হেঁটে পার হওয়া যাবে কি না।

সব জিনিশের ক্ষেত্রে এইরকম ক্যালকুলেশন ব্রেইন করে থাকে। এটা সময় নিয়ে বসে করা ক্যালকুলেশন না, খুব দ্রুত, মুহুর্তের মধ্যে। এটা করে নিয়েই সহজ বোধ বা ইনটুইশনের মাধ্যমে কোন জিনিসকে বুঝে।

আপনাকে যদি বলি, ৮+ ৮ + ৮ +৮ +৮ +৮ +৮ +৮ +৮ কত হয়, আপনি দ্রুত বলতে পারবেন ৭২। কিন্তু যদি বলি ৮ * ৮ *৮ *৮ *৮ *৮ *৮ *৮ *৮ কত, তাহলে আপনি পারবেন না বলতে। খুব বুদ্ধিমান লোকেরাও পারবে না। কারণ এই ক্যালকুলেশন ব্রেইন সাধারণত করতে পারে না। ১৩৪, ২১৭, ৭২৮।

যেহেতু এটি ক্যালকুলেশন করতে পারে না দ্রুত তাই সহজ বোধীয় বা ইনটিউটিভ ভাবে একে বুঝা সম্ভব নয়, ফলত ব্রেইন একে আন্ডারএস্টিমেট করে, বা এর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *